খবর প্রকাশিত: ০৫ মে, ২০২৫, ০৯:৪৮ এএম
বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের সময় বেশির ভাগ মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাজকীয় আতিথেয়তা পেয়েছেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৪-৮৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় হাওয়ার্ড শ্যাফার ছিলেন বৃটিশ আমলের ভাইসরয়ের মতো। প্যাট্রিসিয়া বুটেনিস যিনি জরুরি অবস্থার সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা পালন করেন, ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন শাসনামলে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা বরাবরই তাদের দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। অতীতের ঘটনা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে তারা বাংলাদেশের জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা পাননি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মার্কিন বিরোধিতার জেরে আমেরিকাকে বাংলাদেশের মানুষ একটি সাম্রাজ্যবাদী, গণবিরোধী শক্তি হিসেবে মনে করতো। যার জেরে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্ সব বদলে দিয়েছেন। পিটার হাস্ বাংলাদেশে আসেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বৈদেশিক নীতির মূল বিষয় মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের পথ অনুসরণ করে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ হুমকির মুখে রয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বার্থে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সংগঠিত করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উভয়ই লঙ্ঘিত হয়েছিল। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্ বাইডেন প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির মূল বিষয়গুলোকে অনুসরণ করেছেন। আবেগ ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানুষের এত কাছে পৌঁছে গেছেন, যা তার পূর্ববর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা করতে পারেননি। বাংলাদেশে মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে হাস্ নিজের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন। গত ডিসেম্বরে বলপূর্বক গুমের শিকারদের পরিবারদের নিয়ে ‘মায়ের ডাকের’ সঙ্গে কথা বলার সময় নিরাপত্তার কারণে তাকে সেই সভা থেকে বের করে আনা হয়। কারণ তার পতাকা লাগানো গাড়িতে হামলা চালিয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। তিনি বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্থাপন করেন। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশেই ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের ওপর এমন ধরনের হামলা খুবই অস্বাভাবিক একটি বিষয়। রাষ্ট্রদূত হাস্ ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একজন পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে তিনি কোনো পক্ষ নেননি। তিনি শান্ত থেকেছেন, এটিই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কূটনীতিকের বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার ডেপুটি দাবি করেন, পিটার হাস্ এবং অন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ড অনুচ্ছেদ ৪১ (১) ধারা লঙ্ঘন করেছে।
এই রাষ্ট্রদূতেরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা। ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে প্রেস বিবৃতি দেয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রদূত হাস্-সহ পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের ‘আহাম্মক’ বা বোকা বলে আখ্যায়িত করেন। অথচ কূটনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের শব্দের ব্যবহার কখনো দেখা যায়নি। এরপর রাষ্ট্রদূতদের একটি শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এমন পদক্ষেপ উল্টো বুমেরাং হয়ে তাদেরই আঘাত করে। হাস্ সহ বাকি রাষ্ট্রদূতরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তারা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনৈতিক কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করেননি। ১৩ জন শক্তিশালী রাষ্ট্রদূতকে এক সঙ্গে ডাকা কোনো রসিকতা ছিল না। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিমন্ত্রীকে স্বীকার করতে হয়েছিল যে, রাষ্ট্রদূতদের ডাকা হয়েছিল মূলত চায়ের দাওয়াত হিসেবে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন পদক্ষেপের জবাবে কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতেন পিটার হাস্।
একজন সাংবাদিক তাকে ঘটনাটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত কোনো রাষ্ট্রদূত যদি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে কিছু বলতো তাহলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তা মন দিয়ে শুনতো। রাষ্ট্রদূত হাস্ একই দিনে অনুষ্ঠিত আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কূটনীতি কীভাবে পরিচালনা করতে হয় তা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি শিক্ষা দেন। এর মধ্যে একটি বৈঠক ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে। অন্যটি ছিল বাংলা দৈনিক ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে। উপদেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বৈঠক ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি তোলপাড়। বৈঠকটি বন্ধ দরজার পেছনে হয়েছিল এবং কোনো পক্ষই তাদের আলোচনার বিষয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এসব বৈঠকে সাধারণত রাষ্ট্রদূতরা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। উপদেষ্টার সঙ্গে হাস্-এর রুদ্ধদ্বার বৈঠকটি ইঙ্গিত দেয় যে, মিডিয়ার সামনে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে আসলে রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই আলোচনার সময় সেখানে ছিলেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গ্লোবাল অ্যান্টি-করাপশনের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ। নির্বাচনী ইস্যুতে নয়, বরং অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে এবার একাধিক ব্যবসায়ী, শীর্ষ কূটনীতিক সহ বেশ কয়েকজন আমলাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাখা হবে বলে সেখানে একপ্রস্থ আলোচনা হয়। রুদ্ধদ্বার বৈঠকটি এই শ্রেণির ব্যক্তিদের কাছে বার্তা দেয় যে, তারাও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের জন্য ওয়াশিংটনের রাডারের অধীনে রয়েছে। পিটার হাস্ মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, তাদের নির্বাচনী অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে রয়েছে। মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এবং মানবজমিন অফিসে তার যাওয়া ছিল ইচ্ছাকৃত। তিনি মানবজমিন ও তার প্রধান সম্পাদককে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ মানবজমিন এমন একটি বাংলা দৈনিক, যা বিপুল সংখ্যক মানুষ পড়ে এবং সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকাটি সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি তার সমর্থন জানাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মানবজমিন অফিস সফর করেন।
এটি এমন একটি সময় যখন গণমাধ্যম স্বাধীন নয়। প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়েও স্বাধীন হয়ে কাজ করা এবং সাহসী ভূমিকার জন্য মানবজমিন এবং এর প্রধান সম্পাদকের প্রশংসা করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন পিটার হাস্। মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি’র নাম না করেই অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান হাস্। সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন যে, প্রতিটি ভোটার নির্ভয়ে ভোট দিতে পারলে তবেই শান্তিপূর্ণভাবে সরকার গঠন সম্ভব। পিটার হাস্-এর কূটনৈতিক দক্ষতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনেকটাই কোণঠাসা করেছে। রাষ্ট্রদূত হাস্ তার শান্ত এবং পেশাদার কূটনৈতিক বুদ্ধির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক, মানবিক ও নির্বাচনী অধিকার নিয়ে বার্তা দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা বুঝতে পারছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ জন্য সম্প্রতি ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিদের’ আমন্ত্রণ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যার মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং কলামিস্টরা।
কীভাবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিকদের ‘ম্যানেজ’ করা যায় সে বিষয়ে মতামত বিনিময় করাই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। এই অবসরপ্রান্ত কূটনীতিকরা যদি সত্যি বলে থাকেন তাহলে তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছেন যে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ করার অধিকার রয়েছে। যদিও এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। এদিকে পিটার হাস্ মর্যাদা ও সহানুভূতির সঙ্গে পেশাগত দক্ষতা দেখিয়ে অনেক বাংলাদেশিদের হৃদয় ও মন জিতে নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট বা আইআরআই’র মতো কোনো পোলস্টার চাইলে বাংলাদেশে পিটার হাস্-এর জনপ্রিয়তা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করতে পারে।
লেখক: জাপান ও মিশরের সাবেক রাষ্ট্রদূত