NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, রবিবার, মে ৪, ২০২৫ | ২১ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

বিবিসি- বাংলার ৮১ বছর ও কিছু স্মৃতি--হাসান মীর


হাসান মীর প্রকাশিত:  ০৪ মে, ২০২৫, ০৭:৫৯ এএম

বিবিসি- বাংলার ৮১ বছর ও কিছু স্মৃতি--হাসান মীর

হাসান মীর: বিবিসি বাংলা আগামী ১১ই অক্টোবর ৮০ পেরিয়ে ৮১ বছরে পা দিচ্ছে। এটি সুখবর বটে তবে এই সাথে দুঃসংবাদটি হলো অদূর ভবিষ্যতে বিবিসি বাংলার রেডিও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিবিসি কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যয়সংকোচ নীতির অংশ হিসাবে বাংলাসহ দশটি বিদেশি ভাষার রেডিও অনুষ্ঠান আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিক থেকে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে রেডিওতে প্রচারিত অনুষ্ঠান বন্ধ হলেও অনলাইন ও টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠান বহাল থাকবে। এই জগতে কিছুই তো চিরদিন থাকে না, মানব জীবনের মতো মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তো যা হওয়ার সে তো হবেই ও নিয়ে দুর্ভাবনা করে কাজ নাই বরং এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এতদিন যাঁরা জড়িত ছিলেন এবং আগামীতেও থাকবেন তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাই। তারপরেও মনের কোণে কিঞ্চিৎ বেদনা অনুভব করছি এই ভেবে যে, আমি এবং বিবিসি বাংলা দু'জনেরই জন্ম ১৯৪১'এ ( আমার ২রা জানুঃ ), আমি জরাগ্রস্ত পঙ্গু জীবন নিয়ে বেঁচে রইলাম অথচ যার আরও হাজার বছর টিকে থাকার কথা ছিল তাকেই বিদায় নিতে হচ্ছে।

এবার বর্তমান ছেড়ে অতীতে যাই। একসময় বিবিসি বাংলার চিঠিপত্রের জবাবের অনুষ্ঠান প্রীতিভাজনেষুতে মাঝে মধ্যে দুই -- একজনকে বলতে শুনতাম -- আমি ছোটবেলায় দাদুর কোলে বসে বিবিসির অনুষ্ঠান শুনেছি কিংবা আমি ফোর- ফাইভে পড়ার সময় থেকে বিবিসি শুনছি। তাদের কথা শুনে যেমন হিংসে হতো তেমনি মনে দুঃখও হতো। কুষ্টিয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্ম। শৈশবে রেডিওর নামও শুনিনি, আমাদের কোনো আত্মীয়- প্রতিবেশী দূরে থাক দশ গ্রামে কারো বাড়িতে রেডিও নামক বস্তুটি ছিল না ( দু 'একজনের বাড়িতে কলেরগান বা গ্রামোফোন যদিও ছিল ) । ১৯৬০' এর দশকের শুরুতে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির কল্যাণে গ্রামের মানুষ ট্রানজিস্টার রেডিওর সঙ্গে পরিচিত হয়। আর আমি একুশ বছর বয়েসে নিজের উপার্জিত অর্থে তিনশ টাকায় একটি ফিলিপস রেডিও কিনে জীবনে প্রথমবারের মতো রেডিওর ' নব ' ঘোরানোর সৌভাগ্য অর্জন করি !

এর পরের ইতিহাস অবশ্য ভিন্ন। ষাটের দশকেরই মাঝামাঝি সময়ে করাচিতে থাকাকালে একটি উন্নতমানের রেডিওসেট সংগ্রহ করি। এতে বিশ্বের নানা দেশের বেতার অনুষ্ঠান শর্টওয়েভে ভালো শোনা যেতো। এভাবেই ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে একদিন বিবিসি- লন্ডন থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠান কানে এলো। তখন মিটারব্যান্ড, ফ্রিকুয়েন্সি, সময়সূচী - কিছুই জানতাম না, কোনো ধারণাও ছিল না। বিবিধভারতীর হিন্দি গান শুনতে ভালো লাগছে না, কাঁটা সরাতেই হয়তো মাতৃভাষা কানে এলো, খানিককাল তাই শুনলাম। এ ভাবেই প্রথম কবে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুনেছিলাম এতো দিনে আর মনে পড়ে না। করাচিতে থাকতেই অবশ্য ১৯৬৮ সালেএক বন্ধুর উৎসাহে একবার রেডিওতে সংবাদপাঠের অডিশন বা কণ্ঠস্বর পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। সুবিধা করতে পারিনি। রহিম দাদ নামে যে ভদ্রলোক অডিশনের সময় উপস্থিত ছিলেন, বললেন - ইমম্যাচিওরড ভয়েস, সংবাদপাঠের উপযোগী নয়। এরপর করাচি বেতারেই সংবাদ অনুবাদকের টেস্ট দিয়ে পাস করলাম কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে, আমি আগে যে অফিসে কাজ করতাম তারা ছাড়পত্র দিতে রাজি হলেন না।

১৯৭১ সালে ঢাকায় ফিরে এলাম। এবার ঢাকা বেতারের সঙ্গে সম্পর্ক হলো, কেন্দ্রের তৎকালীন বার্তাসম্পাদক জনাব সাইফুল বারীর কাছে এজন্যে কৃতজ্ঞ। এখানে আমি সংবাদ অনুবাদ, পাঠ, সম্পাদনা -- সবই অল্পস্বল্প শেখার সুযোগ পেলাম। বিবিসিসহ বিভিন্ন বিদেশি বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শোনার অভ্যাস গড়ে উঠলো। কোনোদিন অনুষ্ঠান শুনতে না পারলে মনিটরিং শাখা থেকে ওদের রিপোর্ট এনে পড়ে নিতাম। এরপর একপর্যায়ে বিবিসির প্রতি অনুরাগ এতটাই বেড়ে গেল যে বুশ হাউজে বসে কফি পানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম ! ১৯৮৩ এবং পরে ১৯৯৭ সালে আমি দুবার বিবিসির জন্যে লিখিত ও কণ্ঠস্বর পরীক্ষা ইত্যাদি দিয়ে সফল হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ হয়েছি। প্রথমবার জেমস নরিস এবং দ্বিতীয়বার সৈয়দ মাহমুদ আলীর সঙ্গে অন্য একজন ইংরেজ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কিন্তু কোনোবারই ছিঁকে ছেড়েনি। তবে মাঝখানে অন্য একটা সুযোগ এলো, ১৯৮৮ থেকে ' ৯১- এর মধ্যে সাড়ে তিন বছর টোকিওতে রেডিও জাপান- NHK' র বাংলা বিভাগে কাজ করলাম। সেখানে কাজের পরিবেশ ভালো, কাজের চাপও কম ছিল কিন্তু বিবিসির ব্যাপারটাই আলাদা। কিন্তু মানুষের সব প্রত্যাশা কি পূরণ হয়, কখনো হয়তোবা একজন তার যা পাওয়ার কথা তারচেয়েও বেশি পেয়ে যায়, তারপরেও অতৃপ্তি থাকে। তো সে কথাও থাক।

১৯৮৫ সালে আমি ছিলাম রংপুরে, বাংলাদেশ বেতারে। বিবিসির ' গোল্ডেন ভয়েস ' নূরুল ইসলাম এলেন, বেতার ভবনের স্টুডিওতে শ্রোতা সম্মেলন হলো। আমার কাছে জানতে চাইলেন কেনো আমি বিবিসি শুনি। বললাম -- শুধু বিশ্ব সংবাদ নয়, দেশের অনেক খবরের জন্যেও আমাদের বিবিসির ওপর নির্ভর করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সব খবরের জন্যে তখন তো সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার আর টেলিভিশনের বিকল্প ছিল না অথচ কোন খবরটি দেয়া যাবে আর কোনটি যাবে না এই সিদ্ধান্ত দেয়ার লোক ছিল না। ফলে সন্ধ্যায় বিবিসি যে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি দিতে পারতো , বাংলাদেশ বেতারে তা পাওয়া যেতো পরদিন সকালে। নূরুল ইসলাম সাহেব আমার একটি ছোট্ট ইন্টারভ্যু নিয়েছিলেন, পরে সেটি লন্ডন থেকে প্রচারিত হয়েছিল। ( পরে আরও তিন/ চারবার বিবিসি বাংলায় আমার কণ্ঠস্বর শোনা গেছে ) । ১৯৯১ সালে রংপুরে বিবিসি বাংলার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল, সিরাজুর রহমান ও দীপঙ্কর ঘোষ উপস্থিত ছিলেন, সেখানে তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিবিসি বাংলার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১১ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত শ্রোতা সম্মেলনে আমি অসুস্থতা নিয়েও উপস্থিত হয়েছিলাম কিন্ত এরপর আমার জন্যে বাইরের জগৎ বন্ধ হয়ে গেল । অসুস্থতার কারণে প্রায় দশ বছর ধরে গৃহবন্দি হয়ে আছি, একমাত্র মৃত্যুই এই বন্দিত্ব থেকে আমাকে মুক্তি দিতে পারে। আমি সেই অপেক্ষায় আছি।। ( আমার এই দীর্ঘ ব্যক্তিগত রচনাটি কেউ ধৈর্য ধরে পড়বেন এমন আশা করি না, শুধু লেখার জন্যেই লেখা । )

নিচের প্রথম ছবিতে ১৯৮৫ সালে রংপুরে বিবিসি বাংলার নূরুল ইসলাম ( ডানে ), তাঁর পাশে বেতার কেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক আহমদ-উজ-জামান ( দু'জনেই পরলোকে ) এবং দ্বিতীয় ছবিতে বিবিসি বাংলার ৭০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকা 'সেতুবন্ধনে ' আমার একটি লেখার সঙ্গে দেওয়া ছবি। পুরোনো লেখা, সম্পাদিত ও পরিমার্জিত।