নন্দিনী লুইজা
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার হৃদয়বিদারক খবর আমাদের মনকে শূন্য করে তোলে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, এমনকি সদ্য কর্মজীবনে প্রবেশকারী তরুণরাও এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে আত্মহত্যা এখন এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলা, সামাজিক চাপ, পারিবারিক অস্থিরতা এবং এক নিঃসঙ্গ প্রজন্ম। “আর পারছি না... ভালো থেকো সবাই”—এমন একটি ছোট্ট বার্তা রেখে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নিভে যাচ্ছে কোনো একটি তরুণ প্রাণ। স্কুলের গেটের সামনে, ছাত্রাবাসের বিছানায়, কিংবা নিজের ঘরের দরজায় ঝুলে থাকছে এক সময়ের স্বপ্নচারী মুখ।
পরিসংখ্যান নয়, বাস্তবতাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—বাংলাদেশ আজ এক নীরব আত্মহত্যার মহামারির মুখোমুখি। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে ভয়াবহ হারে, যা একটি জাতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য এক গভীর সংকেত। এই সংকট শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলার সম্মিলিত প্রতিফলন। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তরুণ-তরুণী। এই পরিসংখ্যান যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি এটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার এক গভীর সংকেতও বহন করে। কেন আজকের তরুণ সমাজ জীবনের সম্ভাবনাময় অধ্যায় পেরোনোর আগেই জীবনের ইতি টানছে।
একজন তরুণ তরুণী যখন আত্মহত্যার কথা ভাবে, তখন সে মৃত্যুকে ভালোবেসে নয়, জীবনের ভার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজে। এই পথচলা শুরু হয় অব্যক্ত যন্ত্রণায়, মানসিক ক্লান্তিতে, এবং একাকীত্বের অন্ধকারে। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা এখনো ‘লজ্জার বিষয়’। ‘মন খারাপ? এসব কিছু না ভাবলেই হয়!’—এমন পরামর্শেই থেমে যায় চিকিৎসা। অথচ বিষণ্নতা, উদ্বেগ,আত্মমূল্যবোধের সংকট—এগুলো কোনো দুর্বলতা নয়, চিকিৎসাযোগ্য রোগ। অজ্ঞতা ও সামাজিক ট্যাবু তরুণদের একাকী করে তোলে।ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার কিংবা ব্যক্তিত্বগত জটিলতার মতো মানসিক সমস্যাগুলোকে এখনো সামাজিকভাবে ‘ভয়’দেখা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব রোগের কোনো চিকিৎসা হয় না—বরং পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগুলোকে 'ইচ্ছে করে দুষ্টুমি' হিসেবে দেখিয়ে ফেলে। ফলে রোগ গোপনে বেড়ে ওঠে, এবং এক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নেয়।
অনেক তরুণ বেড়ে ওঠে পারিবারিক সহিংসতা, অভিভাবকদের বিচ্ছিন্নতা বা উপেক্ষার মধ্য দিয়ে। তারা তাদের আবেগ ও সমস্যাগুলো কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। একসময় এই নিঃসঙ্গতা তাদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়। একটা "এ+" না পেলে পরিবারে অপমান, ভালো চাকরি না পেলে সমাজের আঙুল—সব মিলিয়ে তরুণেরা জীবনের চেয়ে ‘সফলতার’ বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত। এই সফলতার সংজ্ঞা যে ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে, এই বোধটাই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ, কিংবা পরিবারে অনুরাগের অভাব তরুণকে এমন এক নিঃসঙ্গ শূন্যতায় ঠেলে দেয়, যা থেকে পালানোর পথ হিসেবে আত্মহত্যাকে সে একমাত্র মুক্তি ভাবে। একজন তরুণের আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতার দলিল। পরিবারে ভালোবাসার অভাব, শিক্ষায় সহানুভূতির অনুপস্থিতি, নীতিনৈতিকতাহীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি তরুণদের ভরসাহীন করে তোলে।কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের আবেগ-ভিত্তিক সম্পর্ক অনেক সময় গভীর হতাশার জন্ম দেয়।
ভালোবাসা প্রত্যাখ্যাত হলে বা সম্পর্ক ভেঙে গেলে, তারা অনেকেই নিজেদের অস্তিত্বহীন ও অপ্রয়োজনীয় মনে করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে কান্না প্রকাশ দুর্বলতা, ভুল করা অপরাধ, আর সহানুভূতি বিলাসিতা। অথচ একজন তরুণ যখন মন খুলে কথা বলতে চায়, তখন সে শুধু একটা কান চায়, একটা কাঁধ চায়—আর কিছু নয়। ইনস্টাগ্রামে হাস্যোজ্জ্বল মুখ, টিকটকে ‘পারফেক্ট’ জীবন, কিংবা ফেসবুকে চটকদার পোস্ট—এসব দেখে তরুণেরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করে। ‘আমি এত পিছিয়ে পড়েছি’—এই বোধ তাকে হতাশার অতল গহ্বরে নিয়ে যায়। কিছু সময় ‘ডার্ক ওয়েব’ কিংবা সামাজিক মাধ্যমে আত্মহত্যা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ বা প্ররোচনামূলক বিষয় তরুণদের প্রভাবিত করে। তারা অনুভব করে, আত্মহত্যা একটি সাহসী বা "সমাধানমূলক" পথ। এই ঘোরতর ভুল ধারণা সামাজিক মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে পড়ে।
আজকের তরুণ সমাজ এক আবেগগত ভাবে বিচ্ছিন্ন’’ সময় পার করছে। তাদের মুখে হাসি থাকলেও হৃদয়ে এক ধরনের গভীর ক্লান্তি কাজ করে। পরিবারে উষ্ণতা নেই, শিক্ষায় মূল্যবোধের চর্চা নেই, বন্ধুত্বে নির্ভরতা কমেছে, অথচ প্রত্যাশা দিনদিন বেড়ে চলেছে। এই অসামঞ্জস্যে তরুণেরা কোথাও গিয়ে মনে করে—“আমার বেঁচে থাকার মূল্য নেই।” করণীয়: মানুষ বাঁচাতে হলে মন বুঝতে হবে- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। কীভাবে মানসিক চাপে সামলাতে হয়, কোথায় সাহায্য পাওয়া যায়—এসব শেখাতে হবে পাঠ্যক্রমের মাধ্যমেই। উপযুক্ত কাউন্সেলিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা: প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একজন প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শক থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণ সহজে এই সেবা নিতে পারলে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেকাংশে কমবে। পরিবারে যোগাযোগ ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি: পিতামাতা ও অভিভাবকদের উচিত সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো, তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা, এবং কোন সংকেত তাকে মানসিকভাবে আঘাত করছে তা বুঝে তৎপর হওয়া। সন্তানের উপর অন্ধ প্রত্যাশা না চাপিয়ে তাকে নিজেকে প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। ‘সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে লোকে কি বলবে’—এই ভয় দূর করতে হলে আমাদের প্রচলিত সংস্কার ভাঙতে হবে। মিডিয়া, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে এই বার্তা ছড়াতে হবে—‘মন খারাপ মানেই তুমি দুর্বল নও।’
পরিবারে ভালোবাসার পরিবেশ গড়ে শুধু পড়াশোনার ফলাফল নয়, সন্তানের আবেগ-অনুভূতির খোঁজ নিতে হবে। মা-বাবার উচিত সন্তানের বন্ধু হয়ে ওঠা, পরামর্শক নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মহত্যা রোধী প্রচারণা করতে হবে, যেভাবে বিভিন্ন ট্রেন্ড ভাইরাল হয়, ঠিক তেমনভাবে আত্মহত্যা বিরোধী, জীবনমুখী, উৎসাহব্যঞ্জক কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার করতে হবে। তরুণদের মাঝে “জীবন সুন্দর”—এই বার্তা পৌঁছানো জরুরি। জাতীয় পর্যায়ে হেল্পলাইন ও কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে যেমন ৯৯৯ নম্বরে পুলিশ পাওয়া যায়, তেমনই ২৪ ঘণ্টা চালু একটি ‘মনো-সহায়তা হেল্পলাইন’ চালু করতে হবে। যেখানে তরুণরা সহজে ও গোপনীয়ভাবে কথা বলতে পারে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসাকে কম খরচে ও সহজলভ্য করতে হবে।
আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বরং এটি একটি নীরব ডাক—সহানুভূতির, বোঝাপড়ার, সাহায্যের। আমাদের সমাজ যদি একটু সহানুভূতিশীল হয়, পরিবার যদি আরেকটু সময় দেয়, শিক্ষা যদি আরেকটু মানবিক হয়—তাহলে হয়তো কোনো তরুণ আর নিজের জীবন শেষ করার কথা ভাববে না। জীবন এক কঠিন পথ, কিন্তু তাতে হাত ধরার মানুষ থাকলে, সেই পথ পার হওয়া যায়।“তুমি একা নও।”—এই বাক্যটি যেন পৌঁছে যায় প্রতিটি তরুণ হৃদয়ে। জীবন সবসময়ই নিঃসন্দেহে কঠিন, কিন্তু একা হলে তা আরও কঠিন। তাই, জীবন বাঁচাতে হলে আমাদের প্রত্যেককে হতে হবে কাউকে না কাউকে অন্যের জন্য আশ্রয়স্থল। হয়তো একটি ফোনকল, একটি হাসিমুখ, একটি হাত ধরা—এটাই হতে পারে কারও জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার ফারাক।
একটি আত্মহত্যা আমাদের ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল—পরিবার হিসেবে, সমাজ হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে। একজন তরুণের চোখে যদি জীবনের আর কোনো রঙ না থাকে, তাহলে সেটা শুধু তার ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের অক্ষমতা—তার পাশে দাঁড়ানোর, তাকে বোঝার, তাকে ভালোবাসার। আজ দরকার একটাই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া—"তুমি একা নও। তোমার কথা শোনার, তোমার পাশে দাঁড়ানোর কেউ না কেউ আছে।"